ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। অষ্টম পর্ব।

 

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবি

শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়

 


আট

 

ভিক্টোরিয়ান এজে সরাসরি চীন-জাপান-কোরিয়ান ছবির একটা ধারা এসে মিশে যায় ইউরোপ-আমেরিকায়। চৈনিক রীতি নিয়ে এই সময় প্রত্যক্ষভাবে নাড়াচাড়া শুরু হয় পাশ্চাত্যে। প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে হাতেনাতে অনুশীলন করা শুরু হয়। জাপানে হকুসাই মারা যাচ্ছেন ১৮৪৯-এ, অর্থাৎ একটা যুগের অবসান। আর ঠিক সেই সময় ইউরোপে যে ধারাটি গুস্তাভ ক্যুরবেটের হাত ধরে সামনে উঠে এলো তা হল রিয়ালিজম। গুস্তাভ প্রধানত রোমান্টিকতাকে অস্বীকার করতেই নিয়ে এসেছিলেন রিয়ালিজমকে। ধীরে ধীরে এই বাস্তববাদ ছড়িয়ে পড়ে জার্মানি, আমেরিকা, ফ্রান্সে। ফ্রান্সকে কেন্দ্র করে রিয়ালিজম যখন ইউরোপে দানা বাঁধছে তখন যুগটা ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধের। একদিকে যেমন শিল্প বিপ্লবের ফলে আসা মূল্যবোধ,  আবার অন্যদিকে ফটোগ্রাফির মতো চূড়ান্ত বাস্তব ইকুইপমেন্টের ব্যবহারিক তাৎপর্যতা বৃদ্ধি। ফলে রোমান্টিকতা ধাক্কা খাচ্ছিল দৃশ্যত জগতের অতিমাত্রায় বাস্তবিক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাস্তববাদ কতটা বাস্তব ছিল? যা দেখছি তাকে ধরে রাখাই কি বাস্তব? বাস্তবের সঙ্গে তার বিরোধিতা কতটা! অথবা বাস্তবতার মধ্যে কল্পনার মিছিল হচ্ছে কিভাবে? আর যখন বিষয়টা আসছে মেয়েদের কল্পজগতের, তখন বাস্তববাদ কিভাবে তাকে আশ্রয় দিয়েছে বা দিয়েছে প্রশ্রয়! এখান থেকে আলোচনা নানান দিকে যেতে পারে। কিন্তু পাঠিকা আমাদের ফিরতে হবে মেয়েদের কথায়। চিত্রীদের অবদানে। মেয়েরা ইউরোপে বাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ক্যুরবেটের কাজের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, নতুন ভাবনায় ইউরোপ ও আমেরিকার চিত্রীরাও রোমান্টিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন বাস্তববাদকে মান্যতা দিয়েছেন; অর্থাৎ এগিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাসী থেকেছেন। চিত্রীদের এক একটা নতুন পদক্ষেপতো তাই ভাবনার দুনিয়ায় এনেছে এই বাস্তববাদ - 

 রোজা বোনহেউর (১৮২২-১৮৯৯) -  তিনি রিয়ালিস্ট স্টাইলের ছবি আঁকেন নি, স্থাপত্যও করেছেন। তাঁর ন্যুন ডে রেস্ট অথবা দ্য চারকোল বার্নার রিয়ালিজমের অন্যতম কাজ। নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটিকে সর্বদা গুরুত্ব দেওয়া বোনহেউর সকল নারী চিত্রীদের কাছে এক প্রেরণা স্বরূপ ছিলেন তৎকালীন সময়ে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৭১ সালে চিত্র ঐতিহাসিক লিন্ডা নচলিনের "why have there been no great women artists? "  এ রোসার ওপর যে লেখাটি রয়েছে তার নারীবাদের একটি অন্যতম সংযোজন।

 ইলেন রবিন্স (১৮২৮- ১৯০৫) -  আমেরিকান চিত্রী রবিন্সের কাজ খুব বেশি আকর্ষণীয়। তিনি আঁকতেন মূলত লতা পাতার ছবি। ফুলের ছবি। যা রিয়ালিজমকে প্রকাশ করতো। তাঁর কাজের ছন্দ নজরকাড়া।

 এমিলি মেরি অসবর্ন (১৮২৮-১৯২৫) -  ভিক্টোরিয়ান এজের চিত্রী এমিলি ছবি এঁকেছেন রয়েল একাডেমীতে। তার কাজগুলো টেনিসন, বায়রন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। নেমলেস এবং ফ্রেম লেস, ইভিনিং অন্যতম কাজ। আর যে কাজটির কথা না বললেই নয় তা হল "ফর দ্য লাস্ট টাইম"। যা ভিক্টোরিয়ান আবেগের বা নেচারের এক অভূতপূর্ব চিত্রায়ন। (ছবি- ২৯)

ছবি- ২৯

 

জুলিয়া হার্ট  বের (১৮৩৫-১৯১৩) -  জুলিয়া ছিলেন হাডসন রিভার স্কুলের সদস্যা। হাডসন রিভার স্কুলের ঘরানাটা রোমান্টিসিজমের হলেও জুলিয়ার কাজগুলো রোমান্টিকতাকে অতিক্রম করে রিয়ালিজমকে ধরার চেষ্টা করে। কালার কনট্রাস্টের মধ্য দিয়ে। তার কাজের ডিটেলিং এক অন্যতম চরিত্র।

 মারিয়া এ-বেকেট (১৮৩৯- ১৯০৪) -  রিয়ালিজমের আরেকটি ধারা হলো 'বারবিজন স্কুল'। মূলত নিসর্গ চিত্র শিল্পীরা এই ধারায় কাজ করেছেন। যেখানে কালার সফটনেস একটা মুখ্য চরিত্র। মারিয়া ছিলেন এই বারবিজন স্কুলের আমেরিকান শাখার ভাবধারায় বিশ্বাসী এক সদস্যা। তিনি ছিলেন মিলেটের প্রত্যক্ষ ছাত্রী। গাছ-পাতা-সমুদ্রের নিসর্গগুলো রিয়ালিজমের ঐতিহ্যমন্ডিত।

 মেরি নিম্মো মোরান (১৮৪২-১৮৯৯) -  নিম্মো ছিলেন এচিং এ পারদর্শী। সত্তরটির মত এচিং নিসর্গ করেছেন। তাঁর আঁকা ছবির মধ্যে "টোয়াইলাইট" ছবিটি আমার ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ পছন্দের। এছাড়া সল্ট ওয়াটার পন্ড, ওল্ড হোমস্টে,  লুকিং সী ওয়ারড এই একই জাতীয় কাজের অন্তর্গত। তাঁর কাজের প্রত্যক্ষতা এবং বোল্ডনেস তাঁকে স্বীকৃতির অন্যতম জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।

 কিটি  কিল্যান্ড (১৮৪৩-১৯১৪) -  নরওয়েজিয়ান চিত্রী কিটি ছিলেন রিয়ালিজমের দ্বারা প্রভাবিত। শিখেছেন রোমান্টিক শিল্পী ফ্রেডিক গুডের কাছে। কিটি অনেক স্টিল-লাইফ, নিসর্গ চিত্র এঁকেছেন। তাঁর নিসর্গ চিত্রগুলিতে রোমান্টিকতার ভাবনা থাকলেও রিয়ালিজমকে নিয়েই তার ভাবনার পরিসর প্রশস্ত থেকেছে সর্বদা। (ছবি- ৩০)

  ছবি- ৩০ 

 

মেরি লুইস ম্যাকক্লোলিন (১৮৪৭-১৯৩৯) -  আমেরিকান সেরামিক চিত্রী মেরি লুইসের কাজগুলিও রিয়ালিজম ঘেঁষা। বিতর্ক থাকতে পারে এ নিয়ে কিন্তু তার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

 আমেলি বরি সৌরেল (১৮৪৯-১৯২৪) -  ফ্রেঞ্চ চিত্রী। আঁকা শিখেছেন অনেকের কাছেই। ১৮৭৪ সালে আত্মপ্রকাশ করেন প্যারিসের স্যালোতে। একাধিকবার পান সম্মাননা। মূলত প্রতিকৃতির কাজ করতেন। তাঁর "আকাডেমি" ছবিটি নারীবাদের অন্যতম কাজ।

 ইভা গঞ্জালেজ(১৮৪৯-১৮৮৩) -  মনেটের  স্টুডেন্ট। মূলত ইম্প্রেশনিস্ট হলেও তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলোতে রিয়ালিজম স্পষ্ট। তাঁর প্রথম দিককার কাজে তিনি প্রাত্যহিক জীবনের উপস্থাপনের দিকে নজর দেন। লেডি উইথ ফ্যান ছবিটিতে জাপানি শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। মর্নিং এওয়েটিং ছবির আলোর বিন্যাস অথবা রিডিং ইন দা ফরেস্টের আবহে বাস্তববাদের ছোঁয়া  সুগভীর।

 এন্না  বিলিনসকা (১৮৫৪-১৮৯৩) -  পোলিশ চিত্রী বিলিনসকা ছিলেন বাস্তববাদের প্রকৃত সমর্থক। তিনি প্রধানত প্রতিকৃতি এঁকেছেন। বিশেষত মেয়েদের। তিনি নিজেও মডেল হিসেবে ব্যবহার করতেন নিজেকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার ছবিতে। তিনি ছিলেন প্রথম পোলিশ মহিলা চিত্রী যিনি আকাদেমির শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ছবি আঁকায় সারাজীবন নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। ১৮৮৪ সালে আঁকা তৈলচিত্র "আ নেগ্রেস" বাস্তববাদের অন্যতম ছবি। শুধু তাই নয় ছবিটির অস্বস্তিকর চাউনি এক্সপ্রেশনের কথাও মনে করিয়ে দেয় যেন, অর্থাৎ ছবিটি প্রকৃতই যুগের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। (ছবি – ৩১)

ছবি – ৩১ 

 

সিসিলিয়া বিউক্স (১৮৫৫-১৯৪২) -  সিসিলিয়া পেনসিলভেনিয়া ফাইন আর্ট একাডেমীর প্রথম মহিলা ছিলেন। তাঁর ছবি এই সময়ে আঁকা হলেও ছিল ইম্প্রেশনিস্ট ভাবধারার দিকে ঝুঁকে, এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর নিউইংল্যান্ড ছবিটির কথা। ১৮৮৮ সালে তাঁর আঁকা "টোয়াইলাইট কনফিডেন্স" এমনই এক ছবি যার অভিঘাত সুদুরপ্রসারী

 মেরি বাশকির্টসেফ (১৮৫৪-১৮৮৪) -  মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে মেরি এঁকেছেন 'দ্য মিটিং' ' ইন দা স্টুডিও' অথবা তার আত্মপ্রতিকৃতি গুলি। "দা মিটিং" ছবিটি বাস্তববাদের সার্থক প্রতিনিধি। আবার তাঁর "স্প্রিং" ছবিতে জাপানি শৈলীর প্রতি একটা টান লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা খুব সাবমিসিভ ভাবে কোথাও উচ্চকিত কোন অনুষঙ্গ ব্যতীতই স্প্রিং একটা বাস্তবতার ওয়ে অব এক্সপ্রসন হয়ে থেকে যায়। 

 হেলেন হাইড (১৮৬৮-১৯১৯) -  আমেরিকান এনগ্রেভার হাইড প্রত্যক্ষভাবে জাপানি রীতির দ্বারা ছিলেন প্রভাবিত। চর্চা করেছেন জাপানি পদ্ধতিতে। মুনলাইট অন দ্য ভিগা ক্যানে একটি রঙিন উড এনগ্রাভিং এর কাজ যেখানে জাপানি শৈলী মুখ্য। তিনি এমিল অরলিপের থেকে জাপানি শৈলী শেখেন। জাপানি শৈলীতে যে ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ডে ইউরোপ তথা আমেরিকায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল হাইড তার অন্যতম সাক্ষী। জাপানি শৈলীর প্রতি তার অনুরাগ ছিল সর্বজনবিদিত। (ছবি – ৩২)

ছবি – ৩২ 

 

ম্যাবেল নিকলসন (১৮৭১-১৯১৮) -  নিকলসনের কিছু কাজ বাস্তববাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবকে ধরে। লন্ডনে বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনী করেন। এই স্কটিশ চিত্রীও জাপানি শৈলী দ্বারা ছিলেন বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাঁর আঁকা 'পরিবার' ছবিটির কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। ছবিটির চলনে একটা গল্প বলার প্রবণতা।

 রিয়ালিজম বা সোশ্যাল রিয়ালিজম ইউরোপকে প্রভাবিত করছে, সে সময় ভারতে কি ছিল! ভারতে তখন মিনিয়েচার পরবর্তী সময়কালের সূচনাপর্ব। ভিক্টোরিয়ান এজের ছায়া পড়া শুরু করেছে ভারতেও। কোম্পানি চিত্রকরদের কাজ  কলকাতা মাদ্রাজ বোম্বাই হতে দিল্লির দিকে যাচ্ছে। যদিও উত্তর ভারতে তখনও মিনিয়েচারের দাপট অক্ষুন্ন। রিয়ালিজম ইউরোপের থেকে গিয়েছিলো আমেরিকায়। আমেরিকার রিয়ালিজম ছড়িয়ে পড়ে, নিজেকে স্বমহিমায় রাখতে পেরেছিল; নইলে ম্যাজিক রিয়ালিজম আমেরিকায় কিভাবে নতুনভাবে উত্থিত হল। রিয়ালিজম ছিলই। আসলে রিয়ালিজমের বীজটা ছিলই। রিয়াল হতে রিয়ালিজম। বাস্তব হতে বাস্তবতাবাদ। একটা প্যারাডক্স। তাই বুঝি ১৯৫০ সালে রিয়ালিজম আবার নতুনভাবে ধরা দিল ইউরোপে নিউ রিয়ালিজম হিসাবে।অমোঘ তার পথ চলা। রিয়ালিজম যেন তাই থেকে যেতে জানে। এখনো তাই রিয়ালিজমকে নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেই যাচ্ছে। প্রযুক্তি রিয়ালিজমকে নতুন এক উত্তেজনা প্রদান করেছ।  কিন্তু উত্তেজনার পরেও যা থাকে তা প্রকৃত শিল্প। রিয়ালিজমের মূল রসদ সেখানেই যা দেখাকে একটা বাস্তবতা প্রদান করে। এটা বাস্তব কে দেখার চাইতে কিছুটা হলেও আলাদা। রিয়ালিজম তাই একটা বহতা। ক্যুরবেটের রিয়ালিজম আজ অনেক পরিবর্তিত। কিন্তু রিয়ালিজমের যাত্রাপথ কিন্তু আজও অব্যাহত। রিয়ালিজম না থাকলে চটজলদি ভিক্টোরিয়ান এজ হতে হবে তো আর্ট মুভমেন্টগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তো না। বাস্তবকে দেখার এই মুক্তি, এই প্রবণতা এবার একটা এমন সমতলে এসে নামল যেখান হতে নদী নানান শাখায় বিভক্ত হবে, ছড়িয়ে পড়বে, ঘটবে বাঁক পরিবর্তন। আগামী খুঁজে পাবে একাধিক শিল্পভাবনা। 

(ক্রমশ)

 

সূচিপত্রে যাওয়ার সূত্র 

Comments

Popular posts from this blog

টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন

গোসানী মঙ্গল অবলম্বনে 'তথাস্তু': রঙ্গন রায়। তৃতীয় পর্ব।