গোসানী মঙ্গল অবলম্বনে 'তথাস্তু': রঙ্গন রায়। তৃতীয় পর্ব।

 

গোসানীমঙ্গল অবলম্বনে

রঙ্গন রায়


আগে যা হয়েছিল 

ভক্তীশ্বর ও অঙ্গনা স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে জামবাড়ী গ্রামে চণ্ডীর পূজা শুরু করল। এদিকে কৈলাসে দেবী চণ্ডী সখী পদ্মাকে জানালেন, দ্বাররক্ষী কান্তনাথ শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে অঙ্গনার গর্ভে জন্মাবে। তারপর ...

 

তৃতীয় পর্ব

 

জামবাড়ী গ্রাম, প্রাগজ্যোতিষপুরের পশ্চিম ভাগ

 

শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার চন্দ্র আকাশে সেভাবে দৃশ্যমান হয় না। ধান কাটবার সরু কাস্তের ন্যায় তার রূপ। পশ্চিম আকাশের নিচে চন্দ্রের এই তিথিটি পৃথিবীর প্রাচীন সময়গণক। কথিত আছে কৃষ্ণপক্ষে গর্ভধারণ করলে সন্তানও হয় কৃষ্ণবর্ণ। ভক্তীশ্বর বিশ্বাস করে। অঙ্গনারও তাই বিশ্বাস। 

প্রতিপদের পরের দিন বৃহস্পতিবার পড়েছে। শুভ দিবস। সেই রাত্রি অঙ্গনার জীবনে বিশেষ ভূমিকাবহুল। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল, বিবাহ পরবর্তী প্রথম রাতটির কথা। স্বামী ভক্তীশ্বর উপগত হয়েছেন তার ওপর। নারীর জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ যে রমণ, তাতে যে এত সুখ, তা ছিল অঙ্গনার কল্পনার বাইরে। 

উদ্ভিন্নযৌবনা অঙ্গনার নরম পেলব শরীরের ওপর দৃঢ় পুরুষের ভারী বন্ধন, তাতে যেভাবে পৃষ্ঠদেশের মৃত্তিকা কেঁপে ওঠে, ওপরে গৃহের ছাদ কেঁপে ওঠে, শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে পরম শীৎকারে, তা হয়তো পুরুষের অজানাই থেকে যাবে। 

চণ্ডীর আশির্বাদ আজ তাদের শরীর জুড়ে খেলে যাচ্ছে। অঙ্গনা মা হবে। ভক্তীশ্বর পিতা। তাদের সন্তান হবে সমগ্র রাজ্যের রাজা। এসব স্বপ্ন নয়তো?

ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে গৃহের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বংশদণ্ড গুলির দিকে চেয়ে পরস্পর বিশ্রাম নিল। স্বাভাবিক করল শ্বাসপ্রশ্বাস। এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এল সুমিষ্ট বাতাস। রমণের অন্তিম মূহুর্ত থেকেই এই বাস পেয়েছিল তারা। তখন একাগ্রতার দরুণ, সেভাবে খেয়াল হয়নি। 

ভক্তীশ্বর অনুভব করল, এমন গন্ধ পৃথিবীর বাতাসে নেই। বস্তুত, একেই বলে স্বর্গীয় সুবাস। কেমন অজানা অনুভূতি এনে দেয়। মনে হয় আর কোনও চিন্তা নেই। মা আছেন। পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রায় তলিয়ে যাওয়া যায়। 

দ্বিতীয়ার চাঁদ আকাশে এই মূহুর্তে দেখা যাচ্ছে না। রাত্রির তৃতীয়  প্রহর এখন। এই প্রহরে তস্কর জাগে। শাস্ত্রে বলে কথাটি।

গবাক্ষ উন্মুক্ত করে ভক্তীশ্বর ঘরে ঠান্ডা বাতাস আসতে দিল। অঙ্গনা এখনও পরিশ্রান্ত। আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে রয়েছে শয্যায়। উপাধান গুলি এলোমেলো হয়ে আছে। ভক্তীশ্বর নিজেই গিয়ে সেগুলো সাজিয়ে রাখল। 

 

দিন যায়। কেটে যায় সপ্তাহ। কাটে পূর্ণাঙ্গ মাস। জীবন এগিয়ে চলে নির্লিপ্ত জামবাড়ী গ্রামের নিস্তরঙ্গ সমাজে। তৃতীয় মাসে অঙ্গনার গর্ভচিহ্ন প্রকট হল। গ্রামে কাণাকাণি পড়ে গেল। ভক্তীশ্বর ও অঙ্গনা বুঝল, মাতা চণ্ডী সদয় হয়েছেন। অতঃপর ক্রমাগত মাস যায়, আর উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় সমগ্র এলাকায়। তিনি আসছেন। 

ভক্তীশ্বরের গৃহে দেখা করতে আসেন মিত্র সোমদেব দম্পতি। আসেন বৃদ্ধ মোড়ল, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। অঙ্গনার সখীরা আসে কেউ কেউ। 

শরীরে বেড়ে উঠছে একটা বীজ। অঙ্গনা অনুভব করে। আনন্দে চোখে অশ্রু চলে আসে মাঝেমধ্যেই। 

এখন তাকে রাতে একা শুতে হয়। এটাই নিয়ম। মঙ্গল শনিবার তার গৃহের বাইরে যাওয়া বারণ। এমনকি নদী পার হওয়াও বারণ। এতে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হতে পারে। আসন্ন রাজনের জন্য এই ত্যাগ স্বীকার সানন্দেই মেনে নিয়েছে অঙ্গনা। মা'ই তো পারেন, সন্তানের জন্য পৃথিবীর সমস্ত কিছু বিসর্জন দিতে! 

ভক্তীশ্বরেরও কিছু কিছু কর্ম নিষিদ্ধ এখন। তার গৃহে মৎস পৌঁছে দিচ্ছে গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী যুবকের দল। এখন তার মাছ ধরতে যাওয়া, পশু হত্যা করা ইত্যাদি অনেক কিছু বারণ। 

অঙ্গনা সবসময় নিজের শয্যায়, উপাধানের নিচে মাছ ধরার পুরোনো জালের লোহা রাখে। একটি লোহার ছুড়িও রাখা থাকে। অশুভ আত্মার কোনো ছোঁয়া, কোনো ঘেরাটোপ যেন স্পর্শ না করে গর্ভস্থ রাজাকে। এগুলো সব প্রাচীন বিশ্বাস। মানতে হয়। মানতে ভালো লাগছে অঙ্গনা ও ভক্তীশ্বরের। তাছাড়া ভক্তীশ্বর নিজে একজন এসবের জ্ঞান সমৃদ্ধ মানুষ। সে না মানলে অন্যান্য সাধারণ মানুষেরা কী করবে?

একেক মাসে, অঙ্গনার বিবিধ খাদ্য দ্রব্য খাওয়ার সাধ হয়। ভক্তীশ্বর এনে দেয় সাধ্যমত। 

নবম মাসে অঙ্গনা অতীব দুর্বল হয়ে যায়। কেবল শয্যায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার। দিন-রাত্রি ভেদ নেই, তার নয়ন ভরপুর থাকে আলস্যে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। অদ্ভুত এক স্বপ্ন। চতুর্দিকে ফণা তুলে সরীসৃপেরা ছায়া দিচ্ছে তাকে। সাপগুলি ভয়ঙ্কর দর্শন। কিন্তু তারা যেন হিংস্র নয়। অঙ্গনাকে ছায়াদান করতে এসেছে। নিদ্রা ভঙ্গ হলে দেখে গবাক্ষের ধারে যে পেপে গাছ, তারই পত্রের ছায়া ছিল চোখের ওপর। অস্বস্তিতে পড়ে অঙ্গনা। এইমাত্র তো সে সাপ দেখল? কোনটা সত্য তবে? 

 

ভক্তীশ্বররা অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ নয়। দারিদ্র্য আছে। কিন্তু গোটা জামবাড়ী গ্রাম তাদের ভালোবাসে। তাই সন্তান জন্মানোর জন্য পৃথক আঁতুড়গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন মোড়ল। অন্যান্য বাড়ির গৃহিণীরা এসে গোবর দিয়ে সম্পূর্ণ মেঝে লেপে, শুকিয়ে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। অঙ্গনা নিজ শয্যায় শুয়ে তার শব্দ শোনে। লোকজনের কোলাহল, আনন্দ ভালো লাগে তার। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে, কারই না ভালো লাগে!

দশম মাসে গঙ্গাজল পানের বড় সাধ হল অঙ্গনার। এই অঞ্চল থেকে গঙ্গার দূরত্ব বহু যোজন। গৌড়ের অপর প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে। কিছু গঙ্গাজল সংগ্রহ করে রেখেছিল ভক্তীশ্বর। ঈশ্বরের এমনই লীলা, অন্য যেকোনো নদীর জল সংগ্রহ করে রাখলেও তা শুকিয়ে যায়, গঙ্গাজল শুকোয় না। এজন্যেই না গঙ্গা পবিত্র! পান করলে শরীর শুদ্ধ হয়!

সমস্ত বিধি মেনে, শুভদিনে শুভক্ষণে, বেদনা সত্যি সত্যি শুরু হল। যে বেদনা বিষম যন্ত্রণার। যার শেষে আছে আনন্দের পরিত্রাণ। অঙ্গনার স্বামীর মুখ দেখতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু উপায় নেই। আঁতুড় ঘরে থাকাকালীন পুরো সময় ঘরে কোনও পুরুষ সদস্য প্রবেশের অধিকার নেই। বাইরের আঙিনায় তাদের স্থান। ভক্তীশ্বরও বাইরে। পার্শ্ববর্তী বাড়ির অভিজ্ঞ বয়স্কা রমণীরা এসেছেন। এসেছেন ধাই। পরিচর্যার কোনো ত্রুটি নেই।

পিঁড়ির ওপরে বসায় তারা অঙ্গনাকে। এখন সে শুতে পারবে না। অন্তিম সময় আসন্ন। পা পিঁড়িতে রেখে উবু হয়ে বসতে হয়। ধাই এর নির্দেশ। এইভাবে বসে থাকা অবস্থার এক পর্যায়ে, সমগ্র সূতিকাগার আলোকিত হয়ে উঠল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ শ্রবণ করল সকলে। একটি শিশুর কান্নার পবিত্র শব্দ। 

চলবে

 

সূচিপত্রে যাওয়ার সূত্র

Comments

Popular posts from this blog

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। অষ্টম পর্ব।

টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন