টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন
সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন
কদমতলা বর্মন
একটা শহর— দুইটা স্টেশন। একটা স্টেশন শহরের মাঝখানে অন্যটা শহরের বাইরে। আরেকটি যদিও শহরের নামে রেল স্টেশন আছে সেটা অন্য শহরে। শহরের মাঝের স্টেশনে দিনে দুই জোড়া ট্রেন সারাদিনে কয়েকবার যাতায়াত করে। দুই খান মেইল ট্রেন কলকাতা যায় আরেকটা সাপ্তাহিক। সব স্টেশনের মতই এই শহরের মধ্যে খানে থাকা স্টেশনটার ইতিহাস আছে। চোখ বুঝলে প্রবীণ নাগরিক সেই ইতিহাস দেখতে পায় এখনো। কিন্তু সেই ইতিহাস জলপাইগুড়ির ভূগোলকে কখনো পাল্টে দিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়নি। নেওয়া সম্ভবও না। শহরবাসীর গলায় মাঝেমাঝে যদিও আক্ষেপ শোনা যায় এনজেপি স্টেশন এখনে হলে শহরটা বদলে যেতে পারত। সে মাসির দাড়ি থাকলে মাসিকে মামা বলা যায় কী না সেটা আলাদা বিতর্কের বিষয়। সারা বাংলায়ই স্টেশন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ছবিটা অনেকটা একই রকম। কিছু ঝুপরি একটা বাজার রেলের জমি দখল করে গজিয়ে ওঠা কিছু দোকানপাট ইত্যাদি… এক্ষেত্রে জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনের চিত্রও একটুও আলাদা নয়।
স্কুল পাঠ্য ভূগোল বইয়ে কোথায় লেখা থাকে না যে জলপাইগুড়ি শহর সমতল ভূমিতে অবস্থিত। বিভ্রান্তি কিছুটা হলেও সেখান থেকে শুরু। জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ কিমি দূরের স্টেশনের নাম যখন এনজেপি হয় আর এনজেপি থেকে সারা বছর প্রায় পাহাড়ের রেখা দেখা যায় সেই যুক্তিতেই ধরে নেয় মানুষ যে জলপাইগুড়ি কোনো এক পাহাড়ি শহর। সেই শহরের কোনো স্টেশনের নাম হয়ত এনজেপি। নামটার মধ্যে জলপাইগুড়ি শব্দটি ছাড়া আর কোনো কিছুতেই জলপাইগুড়ি শহরের সাথে এনজেপির কোনই সম্পর্ক। এনজেপির সব সুযোগ শিলিগুড়ি শহরের জন্য বরাদ্দ। এনজেপির অর্থনৈতিক-ভৌগোলিক গুরুত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই। পাশাপাশি এনজেপি থেকে চল্লিশ কিমি দূরে একটা জেলা শহর যার একটি স্টেশনের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যটি হল জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন।
জলপাইগুড়ি থেকে পুজোর পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। জলপাইগুড়ি (টাউন) স্টেশন থেকেও আকাশ পরিষ্কার থাকলে উত্তরে ভেসে ওঠে বরফ ঢাকা পাহাড়। আবার শুরু হয় বিভ্রান্তি, এটা জলপাইগুড়ি না এনজেপি! বাঙালি টুরিস্ট দুই একবার দার্জিলিং যাওয়ার সময় এনজেপি নামার পুঁজিকে সম্বল করে পাহাড় প্রমাণ যুক্তি তর্ক করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে। সে যাইহোক। জলপাইগুড়ির মানুষের মত যেন আরাম প্রিয় একটা স্টেশন যেখানে সারাদিন তিন চার জোড়া ট্রেন যাতায়াত করে নেহাত দায়ে পড়ে। বিকেল বেলায় প্ল্যাটফর্ম এর একটা দিক হয়ে ওঠে সান্ধ্য ভ্রমণের জায়গা। রাতে শহর ঘুমালে স্টেশনও ঘুমিয়ে পড়ে।
(টাউন) স্টেশন থেকে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের দূরত্ব মেরেকেট সাত কিলো মিটার। এনজেপি থেকে আসামগামী রেল পথের মাঝে এই স্টেশন। দেড়-দুই দশক আগেও এই স্টেশনটি শহর থেকে যেন কয়েক আলোকবর্ষ দূরে ছিল। তখন জলপাইগুড়ি শহরে রিক্সর সাম্রাজ্য। রোড স্টেশনে যে কোনো রিকশা কখনোই একবারে যেতে চাইত না। তারও আগে ইন্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে দিয়ে যেতে হত এই রাস্তায়। একটা প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়াতো কয়েক মিনিটের জন্য। শহরের মানুষের খুব প্রয়োজন ছিল না এই স্টেশনের সেটা যেন বাইরের চেহারা দেখলেই বোঝা যেত। সন্ধ্যার পর নিষ্প্রদীপ একটা স্টেশন আর রাস্তার এক পাশে লাল লাল ছোট কোয়ার্টার। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে কোনই কোন যাত্রী নেমে যে রিকশা পাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিলনা। তাই যাত্রীরাও এনজেপিকেই অনেক নিরাপদ বলে মনে করতেন। অন্ধকার স্টেশন কে পাশে রেখে সশব্দে ট্রেন ছুটে যেত কোচবিহার আলিপুরদুয়ার আসামের দিকেমল। প্রকৃতপক্ষে এনজেপি ও আলিপুরদুয়ার ট্রেন এর ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হওয়ার জন্য ডিভিশনাল টাউন জলপাইগুড়ির উপকণ্ঠে থাকা সত্ত্বেও এই স্টেশন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন বৈশিষ্ট্যগত ভাবে অন্য যে কোন স্টেশনের থেকে একদম আলাদা। লাইন পেরোলেই একটা বিরাট আর ততধিক সুন্দর চা বাগান। বলা যায় একটা স্টেশনের গা ঘেঁষে চা বাগান তৈরি হয়েছে বহুযুগ আগে। এখানে স্টেশন ও চা বাগানের মাঝের রাস্তায় রোববার করে হাট বসে। ফলত শহর থেকে সাত কিমি দূরে একটা বাগান একটা স্টেশন ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের চরিত্র পাল্টে দেয়। স্টেশন ঘুমিয়ে পড়লে হাড়িয়া থেকে শুয়োর সবই পাওয়া যেত এই হাটে। কাঞ্চনজঙ্ঘার রং তখন আরো কিছুটা সাদা ছিল, ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দ আরেকটু তীক্ষ্ণ ছিল জোনাকির ডানায় আরো বেশি আলো ছিল। তারপর একদিন যখন জলপাইগুড়ি শহরবাসীর জীবনেও ট্রান্সপোর্ট রেভলিউশন আসল গোসালা দেবী চৌধুরানীর মন্দির রোড স্টেশন এক ধাক্কায় অনেকটা শহরের যেন কাছে এসে গেল। রোড স্টেশন থেকে শহর অনেক কাছে আসলো ঠিকই কিন্তু পাহাড়টা একটু দূরে সরে গেল যেন। সবুজ ডেঙ্গুয়াঝাড় বাগানের মধ্যে দিয়ে লাইনটা বেঁকে গেলে লাল বা নীল ট্রেনটা রোড স্টেশনে ঢোকে…
রেল ব্যবস্থা ভারতের বুকে বিপ্লব এনেছিল সন্দেহ নেই। রেলপথ দেশকে আধুনিক করেছিল। ইদানীং কালে এনজেপি থেকে গৌহাটি রেল লাইনটার ইলেকটিফিকেশন হয়েছে। ইলেকট্রিক ইঞ্জিন এসে দাঁড়ায় জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে। রোড স্টেশন থেকে টাউন স্টেশনের দূরত্ব মাত্র সাত কিমি। গতি বিকাশ উন্নয়ন যাই বলা যাক না কেন শহরের বাইরে মাত্র সাত কিমি দূর দিয়ে বিদ্যুতের গতিতে চলে গেছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। কোন একসময় টুরিস্ট গাইডে লেখা থাকলেও থাকতে পারে শহরের দুটো স্টেশন ও চল্লিশ কিমি দূরের শহরের নামে অন্য একটি স্টেশন— তিনটি স্টেশন থেকেই পাহাড় দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়।
শুধু জলপাইগুড়ি শহরবাসী লাইট নিভিয়ে ঘুমোলে জলপাইগুড়ি স্টেশনও ঘুমিয়ে পড়ে। খুব ভোরে উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবে বলে বোধহয়।
শেষের লাইনটি যেন পুরো লেখাটিকে একটি কবিতা করে দিলো।
ReplyDelete