সম্পাদকীয় স্মরণঃ শিবসন্তুর ও সোনাটা

 

 শিবসন্তুর ও সোনাটা


সন্তুর যে একটি লোকবাদ্য তা আমরা জানি। যে কোন লোকবাদ্যের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যা হিন্দুস্থানী রাগ-রাগিনী বাজাবার পক্ষে অন্তরায়। রাগ রূপায়ণে স্বরকে ধরে রাখতে হয়, এক স্বর থেকে আরেক স্বরে গড়িয়ে যেতে হয়। এছাড়াও আছে স্বরের আন্দোলন বা দোদুল্যমান চেহারা, কণ্‌ স্বর (একটা স্বর বেজে ওঠার আগে চকিতে অন্য কোন স্বরকে ছুঁয়ে আসে) ইত্যাদি। পাশাপাশি শ্রুতির ব্যাপারটা অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাগ সঙ্গীতের শ্রোতামাত্রই জানেন যে তোড়ী-র কোমল গান্ধার আর মূলতানি-র কোমল গান্ধারে তফাৎ আছে।

সন্তুর বাজাতে হয় হালকা হাতুড়ি দিয়ে তারে আঘাত করে। উৎপন্ন টুং, ডিং, ডং ধরনের স্বরগুলো উৎপন্ন হওয়ার পর ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়ে যায়। স্বরের স্থায়িত্ব সেতার-সরোদের মত নয়, বীণার প্রশ্ন তো আসেই না। কিন্তু সন্তুরের ইউএসপি হলো উৎপন্ন শব্দের টোনাল কোয়ালিটি। কাশ্মীরের মিষ্টত্ব যেন জড়িয়ে আছে সন্তুরের শব্দে! এহেন যন্ত্রে পাহাড়ি ধুন অনায়াসে বাজান যায় কারণ যে কোন অঞ্চলের লোকবাদ্য আসলে ওই অঞ্চলের লোকসুরের স্কেল মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। ডুয়ার্সে ভাওয়াইয়া গানের উপযুক্ত যন্ত্র দোৎরা বা দোতারা। এটা তৈরিই হয়েছে ভাওয়াইয়া সুর বাজাবার জন্য। সন্তুরও তাই। অবশ্য সন্তুর যে কেবল কাশ্মীরেই বাজে এমন নয়।

এহেন যন্ত্রকে রাগ-রাগিনী বাজাবার উপযুক্ত করে তুলতে শিবকুমার শর্মাকে প্রচুর ভাবতে হয়েছে। যন্ত্রটির গঠন এবং বাদনশৈলী, দু-দিক থেকেই ভাবতে হয়েছে তাঁকে। সেতার-সরোদের মত মীড় এই যন্ত্রে আনা সম্ভব ছিল না, শিবকুমার তার  হাতুড়ি দিয়ে তারের ওপর বিশেষ কায়দায় কম্পিত-ঘর্ষণ করে এমন একটি টিরিরিরি রিরি রিরি ধ্বনি উৎপন্ন করতেন যা মীড়ের একটা ইশারা দিত। কেউ অবশ্য বলতে পারেন ওতে রাগের রূপায়ণ ঠিক জমে না। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শিবকুমারকে শোনার সময় আমরা তো জানতাম তিনি সন্তুর বাজাচ্ছেন যেটা রাগ-রাগিনী বাজাবার উপযুক্ত নয় আদৌ।

শিবকুমারের সন্তুর তার আওয়াজ এবং বাদনশৈলীর কারণে সঙ্গীত রসিকদের মন কেড়ে নিতে সময় নেয় নি। সানাই-এর সাথে যেমন বিসমিল্লা খাঁ জড়িয়ে গেছেন, সন্তুরের সাথে তেমনই শিবকুমার। ভজন সাপ্রু, তরুণ ভট্টাচার্যেরাও সমকালে বাজিয়েছেন। খ্যাতিও পেয়েছেন কমবেশি। এঁদের সকলের থেকেই শিবকুমার শর্মা সঙ্গত কারণেই এগিয়ে ছিলেন।

শিবকুমার শর্মা বাজাতেন তন্ত্রবাদ্য বা সরোদ-সেতারের ঢঙে। আলাপ, তারপর জোড়, ঝালা। তারপর গৎ ধরে পুরো ব্যাপারটাকেই আবার তবলা উপস্থিতিতে বাজান। দীর্ঘ সময়ের অনুষ্ঠানে ওস্তাদ-পন্ডিতরা অবশ্য এই রীতিতেই গেয়ে বা বাজিয়ে থাকেন। অতীতে কেউ কেউ একটা রাগের আলাপই হয় তো গাইতেন ঘন্টা দেড়েক। শিবকুমার শর্মার বাদন বার দুয়েক ‘লাইভ’ শুনেছি জলপাইগুড়িতে। প্রথমবার তার সাথে তবলায় ছিলেন আনন্দগোপাল ব্যানার্জি, পরের বার জাকির হুসেন। ক্যাসেটে তো প্রচুর শুনেছি এক সময়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি রাগের আলাপ পর্বটা দক্ষতার সাথেই সামলাতেন, কিন্তু বাজনা জমে উঠত জোড় অংশ থেকে। জোড় হলো আলাপেরই ছন্দোবদ্ধ চেহারা। সন্তুরে দু-হাতে দুটো হাতুড়ির টোকায় পিয়ানোর মত সহজেই একসাথে দুটো স্বর বাজান যায় যা দুটো অক্টেভে থাকতে পারে। এই কারণে সন্তুরে ছন্দোবদ্ধ স্বর প্রচুর আমোদ যোগায়।

রাগ-রাগিনী বাজান ছাড়াও শিবকুমার সঙ্গীত জীবনে অফুরন্ত কাজ করেছেন। মুম্বই চলচিত্র জগতের সাথে জড়িত ছিলেন অনেক দিন। বহু জনপ্রিয় গানের আবহে সন্তরের টোকা আসলে তাঁর হাত দিয়েই বেজেছে। সিনেমায় সুর দিয়েছেন। সিলসিলার গান আজো জনপ্রিয়। গানে সুর বসানর ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর দোসর ছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তবে তাঁর খ্যাতি সংগীত রসিক মহলে সম্ভবতঃ প্রথম ছড়িয়েছিল ‘কল অব ভ্যালি’র মাধ্যমে। এই লং প্লেইং রেকর্ডে কয়েকটি কম্পোজিশন ছিল যার প্রতিটিই উচ্চাঙ্গের। অবশ্য শিবকুমার একা বাজান নি। সাথে ছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া এবং ব্রিজভূষণ কাব্রা। শেষোক্ত শিল্পী বাজাতেন হাওইয়ান গিটার যা একদা বেশ জনপ্রিয় ছিল। শিবকুমার শর্মা পরে নিজেও কম্পোজিশন করেছেন প্রচুর। একটি সংবাদপত্র কোম্পানি আটের দশকের শেষের দিকে ক্যাসেট কোম্পানি খুলেছিল। তারা শাস্ত্রীয় গানবাজনার অ্যালবামই প্রকাশ করতেন ডিজিটাল রেকর্ডিং করে। ‘সাউন্ডস্কেপ’ নামক চারটি ক্যাসেটের একটি চমৎকার সেট নব্বুই-এর গোড়ার দিকেই তারা প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিটি ক্যাসেট একটি থিম-এর ওপর। থিমগুলি ছিল সমুদ্র, পাহাড়, মরুভূমি এবং নদী। পাহাড়-এর কম্পোজার ছিলেন শিবকুমার শর্মা। সেই অ্যালবামে কয়েকটি রচনার একটি ছিল ‘উপত্যকায় ভোর’। শুরুতেই সন্তুরে তিনটি স্বর ডিং-ডিং-টিং এক কথায় চমকে দিয়েছিল। ঊষাকালের হিমালয় যেন ওই তিনটি স্বরে তার গাম্ভীর্য, পবিত্রতা আর রহস্য প্রকাশ করে দিল ধাপে ধাপে। যেন বিথোভেনের কোন অরচিত সোনাটার শুরু!

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল যে একবার ঠিক করেছিলাম বিথোভেনের কোন সোনাটা সন্তুরে বাজাবার জন্য শিবকুমার শর্মাকে চিঠি লিখব। আমার বিশ্বাস তাঁর পিয়ানো সোনাটার কিছু কিছু সন্তুরে দারুন জমবে। চিঠি অবশ্য লেখা হয় নি।

শিবকুমার শর্মার বাজনার সাথে জাকির হুসেনের সঙ্গত একটা দুর্দান্ত আবহ তৈরি করেছে। শিবকুমার নিজে ইচ্ছে করলে উচ্চাঙ্গের তবলিয়া হতে পারতেন, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সন্তুর। জাকির হুসেনের সাথে তাঁর মিলত ভালো। দু-জনেই পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিষয়ে ওয়াকিবহাল। দু-জনেই নিজের বাদনে অসম্ভব ইনোভেটিভ। এদের যুগলবন্দী অতীব সুখদায়ক।

আমরা তাকে মনে রাখব।


সূচিপত্রে যাওয়ার সূত্র  

Comments

  1. ভাল লাগলো।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  3. শুভ্র চট্টোপাধ্যায় যদি সান্ধ্য জলপাইগুড়িতে রাগ সংগীত নিয়ে যদি একটি কলাম লেখেন ভালো হয়। রাগ সংগীতের ওপর এমন একটি স্মৃতি ও বিশ্লেষণ পাঠ মনকে যারপর নাই আরাম দেয়।

    ReplyDelete
  4. এই লেখা একটি দারুণ প্রাপ্তি।অনেক জানালা খুলে গেল।সন্তুর আমার অত্যন্ত প্রিয়।শিবকুমারের লাইভ কিরওয়ানি রাগ বাজানোর ডাবল ডিস্কটি এখনও আছে..

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। অষ্টম পর্ব।

টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন

গোসানী মঙ্গল অবলম্বনে 'তথাস্তু': রঙ্গন রায়। তৃতীয় পর্ব।