ছোটগল্পঃ একটি স্বপ্নের পার্ক। তপেশ দাশগুপ্ত

 


একটি স্বপ্নের পার্ক  

            তপেশ দাশগুপ্ত               

 

এই পার্কটি আমার নিজের আবিষ্কার। আমাদের কোম্পানির হয়ে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে ঘুরতে অত্যাধুনিক এই শহরে এসে পড়েছি। অত্যাধুনিক এই ছোট্ট শহরের বিরল জনসংখ্যা আমাকে অবাক করেছিল। জনসংখ্যার এই স্বল্পতা কিভাবে বজায় রাখা গেছে অত্যাধুনিক এই শহরে, জানতে গিয়ে আমাকে আরো অনেক কিছু জানতে হয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, পরিচালনা, পরিছন্নতা এবং বেঁচে থাকবার সমস্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ হাতের কাছে চটজলদি যোগান পাওয়ার সিস্টেম বজায় রাখবার জন্যে বিজ্ঞানের এই অপরূপ ব্যবহার মানুষ করতে পেরেছে জেনে মানুষ হিসাবে অহংকার হয়েছে। কোন বাহুল্যতা নেই যা চোখের বা মনের পক্ষে বিরক্তিকর। নিখুঁত ভাবে সাজানো যেন শিল্পীর তুলি দিয়ে। তার চূড়ান্ত সৌকর্য যেন শেষ হয়েছে এই পার্কটিতে এসে। 

পাশে বহমান টলটলে নদীর জল থেকে ছেঁকে ভাসিয়ে তোলা সবুজ গালিচা স্রোতস্বিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে যেন তার অতুল ঐশ্বর্য নিয়ে থেমে পরে নীল স্রোতস্বিনীর সাথে তার তুলনা মাপছে। একটু পরেই যেন আবার একই সাথে হাত ধরাধরি করে গল্প জমাতে জমাতে পারি দেবে অজানা কোন সুন্দরের সন্ধানে। চলতে চলতে থমকে থাকা এই সবুজ গালিচা মোড়া জায়গাটা আমার আবিষ্কার বললেও আসলে মানুষের হাতের নিখুঁত পরিচর্যার ছাপ এতে প্রকট ভাবে প্রতীয়মান। আমার আবিষ্কার বলতে প্রায় জনশূন্য এই জায়গাটা আমি খুজে নিয়েছি আমার দুপুর কাটানোর জন্যে। 

এই শহরে আমার আসতে হতো না মিস্টার হুইটসন্  অসুস্থ  না হলে।  আমাদের কোম্পানি পৃথিবীর বড় শহরগুলিকে যেভাবে ভাগ করেছে অত্যাধুনিক, আধুনিক, আধুনিক হতে যাচ্ছে। মেইনলি সে সব দেশের সাথেই আমাদের কারবার।  অত্যাধুনিক এই শহরগুলি কভার করেন হুয়িটসন।  প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নগর উন্নয়নের উপযুক্ততা সেই সঙ্গে সেই জায়গার পাখি কীট-পতঙ্গ সবকিছুর উপস্থিতির সংখ্যা, একে অপরের কতটা প্রয়োজনীয় তার পরিসংখ্যান, উন্নয়নধর্মী কাজ হওয়ার পর তাদের সংখ্যার তারতম্য বের করা আমাদের কোম্পানির প্রধান কাজ। আমার এখানে খুব অল্প দিনের কাজ ছিল।  শহরের মেয়র শহরের বেশ খানিকটা অংশে আচ্ছাদিত ঘাসের ভ্যারাইটির একটা পরিবর্তন করতে চাইছেন। এখন যে ঘাস আছে তাতে এক রকমের পোকা স্বাচ্ছন্দ অনুভব করে, নতুন ভ্যারাইটি তে সেই স্বাচ্ছন্দ নাও থাকতে পারে। ফলে সেই পোকা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা এবং অন্যান্য প্রাণীদের উপর তার প্রভাব বার করতে আমাদের আসা।

প্রথম দিনই একটা অদ্ভুত রেজাল্ট আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে, কনফার্ম হতে পারছিলাম না। আমার যন্ত্রপাতি যা নিয়ে সাধারণত উন্নত হতে যাচ্ছে সেরকম শহরে কাজ করতে যাই। মানুষের সাথে অন্যান্য পাখি, পশু, কীট-পতঙ্গের  পরিসংখ্যানের আনুপাতিক রিডিং এই যন্ত্রে দেখায়। এর যে ধারণা যন্ত্রের যে জায়গায় show করাতো তার গ্রাফ এর নেচার  abruptly এত পাল্টিয়ে গেছে এখানে, গ্রাফটাকে ধরতেই বা বুঝতেই সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। যে রিডিং এখানে show করেছে সেটা যে সঠিক বের করেছি কনফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। একটা শহরে মানুষের সংখ্যা যে অবিশ্বাস্য ভাবে এত কম হতে পারে বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে।  ধাতস্থ হলে মন ফ্রী করার জন্যে দুপুরে হোটেলে বিশ্রামের পরিবর্তে গাড়ি চালিয়ে এদিক ওদিক করবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তখনই এই পার্কটাকে পেয়ে যাই।  চোখের পক্ষে এত soothing সবুজে ঢাকা পার্ক আমি কখনো দেখি নাই। মাঝে মাঝে দিয়ে গাড়ি যাবার রাস্তাগুলোও গাছেদের সাথে এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে যে রাস্তাগুলোও পার্কের একটা সৌন্দর্যের অঙ্গ হিসাবে কাজ করছে এবং তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে বসবার বেঞ্চগুলিকে স্থাপন করা হয়েছে। 

তিন দিন আসার পরও একজন মানুষেরও দেখা পাইনি তবুও নির্জন মনে হয়নি। মানুষ ছাড়াও কি জীবন্ত। গাছ পরিচর্যার জন্যেও কোন লোক চোখে পড়েনি। শুধু দূরে পার্কের শেষ সীমায় স্বপ্নের মত একটা দোতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তৃতীয় দিনে আমার নির্দিষ্ট জায়গায় বসবার পর সেখান থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। পার্কটি ঘুরে বুঝেছিলাম বসবার জায়গাগুলি থেকে সম্পূর্ণ পার্কটি টিভির পর্দার মতো সম্পূর্ণ দৃষ্টি গোচরে আসে কিন্তু কোনখান হতেই বসবার জায়গাটিকে দেখা যায় না। কিন্তু মেয়েটির সটান নির্ভুল পায়ে লাল বাড়িটির থেকে বেরিয়ে আমার বেঞ্চের সামনে চলে আসা সেই ভুল ভাঙ্গালো। ও আমার সবকিছুই লক্ষ করতে পেরেছে।

মেয়েটিকে প্রথমে মনে হলো ও এই নির্জনতারই এক অংশ বিশেষ। আমার মনে নির্জনতাকে উপভোগ করার যে আবেশ তৈরি হয়েছিল ও তাতে নতুন মাত্রা যোগ করা শুধু নয় মানসিক কোনো চঞ্চলতা বোধ করবার পরিপন্থী আবেশ সৃষ্টি করলো। এই নির্জনতার মধ্যে আমার পাশে একই বেঞ্চে বসা ওর উপস্থিতি আমার ভেতরে এত সহজভাবে গ্রহণীয় হলো যে ওর দিকে না তাকিয়েও আগের মত সামনের জলধারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অলস সময়কে গরিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলাম। গড়িয়ে যাওয়া অলস সময়ের থেকে ওর গলায় শব্দ ফুটে বেরোল। সেই সময়েই যেমন করে কাউন্টডাউন করে পল অনুপল মেপে সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করা হয় তেমনি আমার মস্তিষ্কের কোষগুলিকে বিশ্রাম থেকে না জাগিয়ে আমার প্রতি ওর আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকলো। আমি কি মনে করে এই বাগানটিকে পছন্দ করেছি। বাগানের কোন জিনিসটা আমার বেশি ভালো লাগছে। কোন জিনিসটা একটু অন্যরকম হলে ভালো হতো এবং সে আমার অনুভূতির উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছিল। অদ্ভুত বিষণ্ণতায় সাজানো ওর মুখ আমার থেকে বিদায় চাইল যখন এবং নির্নিমেষ ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে যতক্ষণ না ওই লালবাড়িটায় মিলিয়ে গেল আমার অনুসন্ধানের পালা শুরু করতে পারছিলাম না। এই বাগানের পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা মেয়েটি নিয়ে ভাবার ক্ষমতা যেন হঠাৎ করেই নির্বাপিত হল। এবং জেগে ওঠার মত করে বিশ্রামের পালা শেষ হলে যেমন হয় আমার কাজের জগৎ আমার চিন্তায় ফিরে আসতে থাকলো। 

এই শহরের অদ্ভুত নিয়ম বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট কাজের সময়ের দিন পার হলে একদিন ও থাকা যাবেনা। কাজ অপূর্ণ থাকলেও চলে যেতে হবে। এই জন্যে কোম্পানির থেকে একটু বেশি কাজের দিন ধার্য করে নেওয়া হয়। এই ব্যাপারে নিয়মের কড়াকড়ির কারণটা যেন একটু একটু ধরতে পারছি। যখন আমার মাথায় এসছিল ওরা একচেটিয়া ভাবে এত টাকা দিয়ে আমাদের কাজ করায় কেন। বিশ্বস্ততার গুরুত্ব এব্যাপারে সর্বাধিক। আধুনিক হতে যাচ্ছে দেশগুলোয় কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি মানুষের সংখ্যার হিসাব কেউ ঠিকমতো ঘোষণা করছে না অনেকটা বাড়িয়ে বলছে। অত্যাধুনিক এই শহরগুলিতে যে এত বাড়িয়ে দেখায় আমার ধারণার বাইরে ছিল। প্রথম অবস্থায় আমি মনে করেছিলাম আমার মেশিন গোলমাল করছে। মাথায় বজ্রপাত হওয়ার মত ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা মাথায় এসেছিল। মিস্টার হুইটসনও মুখে কুলুপ এটে ছিল এ ব্যাপারে কোন আলোকপাত করতে চায় নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার শহরে এই কয়দিন কাটিয়েও এত মানুষের সাথে মিশে মেশিনের রিডিং এর সাথে নিজের দেখার সামঞ্জস্য পাচ্ছি না। 

অফিসে ফিরে জানতে পারলাম আগামীকাল সকালে মিস্টার হুইটসন আসছে। এখানকার অফিশিয়ালসরা আমাকে ঠিক পছন্দের মধ্যে আনছেন না। আমার সাথে তাদের না খোলামেলা আচরণে মনে হয়েছিল। সেই কারণেই হয়ত মিস্টার হুইটসনকে  কিছুটা অসুস্থতার মধ্যেই আসতে হচ্ছে। পরের দিন মি.হুইটসনকে দেখে খারাপ লাগলো এত অসুস্থ শরীরে আসতে হয়েছে। জানতে পারলাম ও না এলে কন্সাইনমেন্টটা বাতিল হত। আমার যে ডেটা বার করেছি সেসব ওদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে না। আমার নিজের ধারণার ওপর কনফিউশন তৈরি করা যে ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল বুঝতে দেরি হয়েছে। যখন বুঝতে পারলাম তখন সবকিছুই একসাথে বুঝতে পারলাম। একটা অপূর্ণতা টের পাচ্ছিলাম নিজের ভেতরে। খটকা লেগেছিল। জট ছাড়াতে পারছিলাম না। হুইটসন এসেছে আমাকে ফিরতে হবে। কোথায় লাগছে। কাজ করতে এসে প্রথম পাঠ শিখেছি কাজের জায়গায় কোন ব্যক্তিগত অভিমান রাখতে নেই। এখন চাইলেও ফিরিয়ে আনতে পারব না অভিমানের সেই দিনগুলি। তবুও চলে যেতে লাগছে। অভিমান নয়, অপরিপূর্ণতা রয়ে গেছে কোথাও? আতিপাতি করে কাজের জায়গাগুলোয় ভেবে বার করার চেষ্টা করি যেরকম হওয়ার কথা ছিল সেরকম কিছু একটা হয়নি। সে তো এই শহরের অনেক কিছুই আমার ধারণা ওলট-পালট করে দিয়েছে এমনকি আমার মেশিনপত্রও এই শহরের অত্যাধুনিকতার সাথে তাল রাখতে পারেনি। 

 হুইটসন এসেই কাজে বেরিয়েছে। ফাঁকা ঘরে অলস হাতে তামাকহীন সিগারেটে লুকিয়ে আনা তামাক ভরতে ভরতে হঠাৎ করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল আকাশের নিচে নদী চলতে চলতে পাশে নামিয়ে দিয়ে গেছে নিখুঁত মন ভালো করা জীবন্ত অথচ নির্জন সবুজ একটি পার্ক। কোথাও একটা খুঁত আছে নিশ্চয়ই। বুঝতে পারি এতক্ষন এই বাগানটিকেই আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। অবচেতনে বারবার হানা দিচ্ছিল। মনের ব্যস্ততা দেখে ফিরে ফিরে গেছে অবসরে আসবে বলে। আমি শুধু শুধু উচাটন হয়েছি। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পার করে দয়িতকে চিনতে পারার মত পার্কটিকে আমি চিনতে পেরেছি আমার ঔৎসুক্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।

কিছুতেই পৌঁছতে পারছিনা লালবাড়িটায়। বেরনোর সময় মনে করে বেরিয়েছি আজকে লালবাড়িটায় যেতেই হবে। পার্কটা আর টানছিল না। আমি কি কিছু ছিন্ন করেছি। পার্কটির টানকে অস্বীকার করতে পারছি কিভাবে। মেয়েটি আমার পক্ষে? কেমন করে যেন বসিয়ে নিত। 

ওদের নির্দিষ্ট করা পার্কের বেঞ্চটিতে বসছি না। পার করে হেঁটে যাচ্ছি লালবাড়িটির দিকে। শেষ মুহূর্তে এসে হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। পার্কের সুদৃশ্য রাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছি। চলে আসছি বেঞ্চটির কাছাকাছি। এবং অস্বীকার করছি আমার ঢুকে যাওয়া। বেঞ্চ। মেয়েটি কার দলে। লালবাড়িটি জয় করতে মেয়েটি আমার পক্ষে? একটু একটু মনে হচ্ছে। ওর বিষন্নতা দেখেছি।

দ্রুত গাড়ির আওয়াজ ঘিরে ফেলছে পার্কটিকে। আমি প্রাণপণ যেতে চাইছি বাড়িটির ভিতর। পোকাগুলি উড়ে উড়ে আসছে। ক্রমে একটা বলয়  তৈরি করল তার ভিতর দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছি।

 

 

Comments

Popular posts from this blog

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। অষ্টম পর্ব।

টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন

গোসানী মঙ্গল অবলম্বনে 'তথাস্তু': রঙ্গন রায়। তৃতীয় পর্ব।