এক গোলা পাঠকের অনধিকারচর্চাঃ পুরঞ্জয় ভৌমিক
এক গোলা পাঠকের অনধিকারচর্চা
পুরঞ্জয় ভৌমিক
বইটি উপহার দিয়ে আমাকে বললেন, এটা দেবেশ রায়ের লেখা শেষ উপন্যাস। খুশি মনে বাড়িতে এসে খুলে দেখি প্রকাশ হয়েছে এ বছরই। তাহলে তো এটা নতুন উপন্যাস। নতুন লেখা আর শেষ লেখা এক হয় কী করে! তাহলে কি তাঁর জীবনকালের শেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়ে নতুন হয়ে গেল। কিন্তু শেষের বিপরীত তো প্রথম। আর নতুনের বিপরীত পুরনো। তাহলে নতুনটাই যদি শেষ হয়ে যায়, প্রথমে কি পুরনো রয়ে যাবে? ইস্কুলে তো নতুন ছেলেদের নিয়েই প্রথম ক্লাস হয়, পুরনোরা থাকে শেষ ক্লাসে। আর ফেল করলেও পুরনোরা একই ক্লাসে, তখন লাস্ট বেঞ্চ। দিক গুলিয়ে যাওয়ার মত। একবার চেন্নাই ( তখনকার মাদ্রাজ) যাওয়ার সময় সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ট্রেনটা চলছে উল্টোদিকে। তাহলে কি হাওড়া চললো দিক ভুল করে? একজন বললেন এতক্ষণ একটু পশ্চিমে যাচ্ছিলেন এখন যাচ্ছেন দক্ষিণে। আরেকজন বললেন, না না একটু পূব ঘেঁসে যাচ্ছিলেন, এখন দক্ষিন দিকে। উনি বললেন, তা কি করে হয় পশ্চিমবঙ্গটাই তো পূর্ব দিকে। পূবেই তো ছিলাম, আবার পূবে যাই কী করে? কি গেরো! চেন্নাই তো সাউথ বলেই জানতাম, তো এরা কি এত পূর্ব-পশ্চিম বলছেন? ম্যাপে তো পুরোটাই দক্ষিণ দেখায়। নাকি ম্যাপে যা দক্ষিণ, যাত্রাপথে সেটাই কখনো পূব, কখনো পশ্চিম, কখনো নৈঋত, কখনো ইশান হয়ে উঠতে পারে। নাকি দিক পুরোটাই আমার অবস্থান নির্ভর? নাকি এই অনন্ত আবর্তনে না পড়লে যাত্রা করাই যায় না?
শেষটা এই সিদ্ধান্তে আসতে চাইছিলাম যে 'স্বপ্ন পুরুষের খোঁজে জুলেখা' দেবেশ রায়ের শেষ লেখা নতুন উপন্যাস বা নতুন উপন্যাস যেটা তিনি শেষ লিখেছিলেন বা কোনোটাই নয়, যেহেতু আখ্যানের নতুন পুরনো হয় না বা যেহেতু আখ্যানের শেষ হয় না। বা ঘুরিয়ে বললে আখ্যান এমনই এক চলন যার পাকে পড়লে তার শুরুও বোঝা যায় না, শেষও বোঝা যায় না। নাকি উপন্যাস পাঠ এমনই এক অলাতচক্র যার প্রবেশ আছে, নিষ্ক্রমণ নেই।
যৌবনকালে শুনতাম দেবেশ বেশ একজন দুর্বোধ্য লেখক। তখন অবশ্য বুঝিনি এ কথায় নিজের 'বোধ'কেই অসম্মান করা হয়। যখন প্রৌঢ়ত্বের শুরুতে এ সব বোঝার সময় এলো তখন দেখলাম সাহিত্য'বোধে'র সম্মান-অসম্মান তো দূরের কথা এ সব আপদ-বালাই চুকেই গেছে প্রায়। সেই সময়ে দেবেশ রায়ের একটা উপন্যাস বিষয়ে এক বন্ধুর মতামত চেয়েছিলাম। সে বলেছিল, 'খুব ভালো লেখা, তবে কি জানিস প্রথম পরিচ্ছেদটা পড়ে একটু চা খেতে গিয়েছিলাম, আর ফিরে আসা হয়নি!' সে অন্তত প্রথম পরিচ্ছেদটা পড়েছিল। আমার তো শুরুই করা হলো না। প্রকাশকের নাম, লেখকের নাম, প্রথম প্রকাশ --- এই পৃষ্ঠাতেই আটকে গেলাম। অথচ শুনতে পাচ্ছি অসীম সাগরের কলধ্বনি, সমুদ্র যাত্রার আহ্বান। যার দিক নেই, নূতন নেই, পুরাতন নেই, শেষ নেই। দেখতে পাচ্ছি আদিগন্ত বালি আর বালির মরুভূমি। আছে শুধু যাত্রা। কখনো কূলহীন বালুরাশির তরঙ্গমন্দ্রিত আহ্বান, চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের ওপর ফসফরাসের ঝিকিয়ে ওঠা, কখনো চরাচর বিস্তৃত মরুসমুদ্রে দাস ইউসুফের যাযাবর যাত্রা। কখনো স্বপ্নে আসে আজিজমিশির বা জুলেখার শরীরে কাম আসে স্বপ্ন হয়ে। কখনো রাতপাখিরা ডানায় ডানা বেঁধে কুয়োর ওপর পাক দেয় কারন তারা দিনের আলোয় দেখতে পায়না, তাই তারা কুয়োর গভীর আর তার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে দেখে ফেলে কোনো মানুষকে , আর সেই সঙ্কেত বৃদ্ধ যাযাবরের চোখ চিনে নেয় নির্ভুল।
আমি সেই বালির সমুদ্রে পা রাখলাম। তারপর আল্লাহ জানে ... তারপর গল্পের ঠাকুরের সঙ্গে লেখকের কথোপকথন। লেখক তো গল্পটা ভেবে নিয়েছেন লিখবেন বলে। আর ঠাকুর তুলছেন একটার পর একটা ফ্যাকরা। গল্পটা ভেবে নিয়েও লেখক লিখতে পারেন না কারন ঠাকুরকে টপকে লিখবেন কি করে। তাই লেখক বেশ একটা জুতসই মোক্ষম সুযোগ খোঁজেন কারন এ গল্প তো লেখা হয়ে গেছে কত জন্ম আগে তার হিসেবও নেই। বা কত জন্ম ধরে লেখা হয়ে আসছে নেই তারও হিসেব। তারপর কখন যে বেশ গল্পটা শুরু হয়ে গেল ঠাহর করতে না করতেই জুলেখা স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল তিনবার। তারপর একটা গোটা মরুভূমি পারাপার আর জুলেখার বিয়ে , যে বিয়ে নাকি আসলে বিয়েই ছিল না। যে বিয়ে নাকি এক প্রতীক্ষার যাত্রা, এক স্বপ্নবিশ্বাসেরও।
তারপর ... ।
Comments
Post a Comment