বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাঃ সহজ যান। সুপ্রিয় ঘটক।



 

সহজ যান

সুপ্রিয় ঘটক 

 

 

এখন থেকে প্রায় আট বছর হতে চললো পশ্চিমবঙ্গের আরও অনেক ছোট শহরের মতো আমাদের এই শহর জলপাইগুড়িতেও স্বল্প  দুরত্বের যাত্রী পরিবহণে এক বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এক সময়ের অতি পরিচিত সাইকেল-রিক্সা আজ শহরে প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। রিক্সার জায়গা নিয়েছে ব্যাটারি চালিত ই-রিক্সা, প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে - ‘টোটো’। আশঙ্কা হয় পরবর্তী প্রজন্মের বাচ্চাদের হয়তো বইয়ে ছবি  দেখেই রিক্সা চিনতে হবে!তবে এখনও শহরে দু-চারটে রিক্সা চলে- কাজেই রিক্সা নিয়ে আলোচনার এই শেষ সুযোগ।  একেবারে বিলুপ্ত হওয়ার আগে বরং এখানে রিক্সার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে কিছু কথা বলে ফেলি।  

গত ২৩শে এপ্রিল, ২০২২-এর সান্ধ্য জলপাইগুড়ি সংখ্যায় আমি সাইকেলের বিজ্ঞান নিয়ে দু-চার কথা লিখেছিলাম। সাইকেলের প্রযুক্তির সঙ্গে রিক্সার মিল প্রচুর- চাকার গঠন, ব্রেক পদ্ধতি বা প্যাডেল-চেইনের মাধ্যমে টর্কের পরিবহন – সবই এক। সান্ধ্য জলপাইগুড়ির ঐ সংখ্যায় সাইকেল প্রসঙ্গে এ সব কিছুরই আলোচনা হয়েছে। অতএব প্রযুক্তির দিক দিয়ে সাইকেলের সঙ্গে রিক্সার পার্থক্য কি সেটাই বরং দেখা যাক। যে প্রধান পার্থক্যটি সহজেই চোখে পড়ে তা হলো রিক্সার তিনটি চাকা আর সাইকেলের দুই। কাজেই সাইকেলে ভারসাম্য নিয়ে যে ভাবনাটা  আছে সেই ভাবনা রিক্সার নেই।  

কিন্তু না, ভারসাম্য না হলেও তিন চাকার জন্য রিক্সায় এক আলাদা রকম সমস্যা উপস্থিত হচ্ছে। সেটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু চার চাকার মোটর গাড়ির সাহায্য নিতে হবে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, রিক্সার চাকার সংখ্যা সাইকেল থেকে যেমন এক বেশি তেমনি মোটর গাড়ি থেকে এক কম! আর এই নতুন সমস্যাটি যেহেতু চাকা নিয়েই তাই মোটর গাড়ির উদাহরণ সুবিধাজনক হবে।  

প্রথমে তাহলে গাড়ির প্রসঙ্গে আসা যাক। সাইকেলে বা সাইকেল-রিক্সায় আমরা পা দিয়ে প্যাডেলে চাপ দিয়ে যে টর্ক তৈরি করি গাড়িতে সেই টর্কই তৈরি হয় ইঞ্জিনে- প্রায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে। সাইকেলে প্যাডেলে তৈরি টর্ক চেইনের মাধ্যমে পেছনের চাকায় যায়, তাকে ঘোরায়, ফলে সাইকেল চলতে থাকে। সামনের চাকা থাকে স্বাধীন --- সাইকেল চলতে থাকলে সেও ঘুরতে থাকে --- ঠিক যেমন ভাবে খেলনা গাড়ি ঠেলে দিলে তার চাকা ঘোরে। গাড়ির বেলায় একজোড়া চাকা থাকে স্বাধীন আর একজোড়া চাকায় ইঞ্জিনে তৈরি টর্ক পাঠানো হয়। স্বাধীন চাকা জোড়া প্রত্যেকেই আলাদা ভাবে স্বাধীন, প্রত্যেকেই নিজের মতো ঘুরতে পারে। সাধারণত বাস, ট্রাক ইত্যাদি বড় গাড়িতে পিছনের চাকা জোড়া ইঞ্জিনে তৈরি টর্কের মাধ্যমে সরাসরি ঘোরানো হয় এবং মোটর ইত্যাদি তুলনামুলক হালকা গাড়িগুলিতে সামনের চাকা জোড়া ঘোরানো হয়। আমার আলোচনায় পেছনের চাকা জোড়ায় টর্ক যাচ্ছে এমনটাই ধরে নিচ্ছি এবং সেই রকম একটি মোটর গাড়ির টর্ক পরিবহণের মূল কাঠামো নীচের ছবিতে দেখানো হলো।   

এবার দেখা যাক এইরকম একটি গাড়ি যখন রাস্তায় চলতে চলতে ডান বা বাম দিকে বাঁক নেয় তখন কি ঘটে। নীচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি গাড়ি বাম দিকে বাঁক নিচ্ছে। বোঝার সুবিধার জন্য শুধু পেছনের চাকা জোড়াই দেখানো হলো। 

 

 

ওপরের ছবিতে ক-খ হলো পেছনের চাকা জোড়ার প্রথম অবস্থান। বাঁক নেওয়ার পর খানিক সময় পর তাদের অবস্থান গ-ঘ বরাবর। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো যে বাঁক বরাবর চলতে চলতে ডান দিকের চাকাটি যে দুরত্ব অতিক্রম করেছে (খ-ঘ বৃত্তচাপ) তার দৈর্ঘ্য বাম দিকের চাকার অতিক্রান্ত দুরত্বের (ক-গ বৃত্তচাপ)চাইতে বেশি। মনে রাখতে হবে এই আলাদা আলাদা দুরত্ব তারা একই সময়ে অতিক্রম করেছে, অর্থাৎ ডান দিকের চাকার বেগ বেশি আর বাম দিকের চাকার বেগ কম হলেই এটা সম্ভব। একই ভাবে গাড়িটি যদি ডান দিকে বাঁক নেয় তখন আবার বাম দিকের চাকার বেগ ডান দিকের চাকার তুলনায় বেশি হতে হবে । আবার যখনই গাড়িটি সোজা রাস্তায় চলতে থাকবে তখন সব চাকাকেই সমান বেগে ঘুরতে হবে। যদি বাঁক নেওয়ার সময় চাকাগুলো আলাদা বেগে ঘুরতে না পারে তবে বাঁক নেওয়া সম্ভব হবে না এবং গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বাইরে গিয়ে পড়বে। আবার সোজা রাস্তায় চাকাগুলো যদি আলাদা বেগে ঘোরে তবে তার অবস্থাও তথৈবচ হবে। 

কিন্ত বাস্তবে গাড়ি দিব্যি বাঁক নেয় এবং দিব্যি সোজা রাস্তায় চলে। সামনের দু চাকা স্বাধীন, তারা যেমন খুশি বেগে ঘুরতে পারে, তাদের সঙ্গে ইঞ্জিনের কোনো যোগ নেই। কিন্তু পেছনের দুই চাকা তো ইঞ্জিনের সঙ্গে একটি শক্ত টর্ক পরিবহণকারী দণ্ডের সাহায্যে যুক্ত, সেখান থেকে পাওয়া শক্তির জোরেই তো তাদের ঘূর্ণন, তাদের বেলায় কেমন করে দু রকম বেগ  হচ্ছে? এই ভিন্ন গতি দেওয়ার জন্য গাড়িতে একটি অতিরিক্ত যন্ত্রের কারসাজি প্রয়োজন – যার পোশাকি নাম ডিফারেন্সিয়াল (Differential) মেকানিজম। পেছনের দু চাকার মাঝখানে হাঁড়ির মতো ফোলা জায়গায় এর অবস্থান। ট্রাকের এই ডিফারেন্সিয়াল হাঁড়ির মধ্যে অনেক সময় এক বিকট দর্শন মুখ আঁকা দেখতে পাওয়া যায়। যাই হোক, এই ডিফারেন্সিয়ালের বর্ণনা দেওয়া এই লেখার সীমার বাইরে, আমাদের শুধু জানা রইলো এই ডিফারেন্সিয়ালের জন্যই পেছনের চাকাগুলিতে প্রয়োজনে আলাদা বা ‘ডিফারেন্ট’ বেগ পাওয়া যায়। ইনি না  থাকলে গাড়ি বাঁক নিতে পারতো না, সে এক যা তা কাণ্ড ঘটতো!  

এবার আসল কথায় আসি। রিক্সার বেলায় বাঁক নেওয়ার সময় কি হবে? রিক্সার বেলায় প্যাডেলে তৈরি টর্ক তো পেছনের দুই চাকায় যায়, তবে বাঁক নেবার সময় যদি সমান বেগে দুটো চাকাই ঘুরতে থাকে তবে তো রিক্সায় চড়াই বিপদ! বাঁক নিতে গিয়ে প্রত্যেকবারই রাস্তা ছেড়ে নর্দমায় পড়ার কথা ! আবার রিক্সায় তো ডিফারেন্সিয়ালও নেই, লাগানো সম্ভবও নয়। অমন একটা জটিল যান্ত্রিক জিনিষ রিক্সায় লাগানো কঠিন ব্যপার সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। 

হ্যাঁ, রিক্সার প্রযুক্তি কঠিন হওয়া মোটেই চলবে না, বরং তাকে হতে হবে একটি সহজ যান। তাই ডিফারেন্সিয়াল-এর বদলে রিক্সায় একটি সহজ সমাধান করা হয়েছে। পেছনের চাকা জোড়ায় চেইনের মাধ্যমে টর্ক না পাঠিয়ে শুধুমাত্র পেছনের একটি চাকাকেই ঘোরাবার ব্যবস্থা করা আছে। অর্থাৎ রিক্সার তিনটি চাকার মধ্যে মাত্র একটি চাকাকেই সরাসরি ঘোরানো হয়, বাকি দুটি চাকাই স্বাধীন ভাবে ঘোরে। এমনটা করা সম্ভব হয়েছে কারণ রিক্সা গাড়ির মতো ভারি নয়, গতিবেগও তার অনেক কম। ফলে একটি মাত্র চাকা ঘুরিয়ে রিক্সার ওপর চাপানো সমস্ত ভার বহন করা সম্ভব, সেটা গাড়ির ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। যারা ছোটবেলায় অ্যাডভেঞ্চার করে রিক্সা চালাবার চেষ্টা করেছেন তারা প্রত্যেকেই জানেন রিক্সার প্যাডেলে চাপ দেওয়া মাত্রই রিক্সাটি অবধারিত ভাবে রাস্তার ধারের নর্দমার দিকে এগিয়ে যায় – খুব শক্ত করে হ্যান্ডেল সঠিক দিকে চালিত না করলে নর্দমায় পড়তে হবেই। এর কারণ তিনটে চাকার মধ্যে মাত্র একটিই প্রথমে ঘুরতে চায়- কারণ তাকে সরাসরি ঘোরানো হয়। বাকি দুটো চাকা স্থিতিজাড্যের জন্য চলতে চায় না, ফলে শুরুতে শুধু একটি চাকার গতির ফলে রিক্সা যেন একদিকে চলে যেতে যায়। অবশ্য একবার গতি পেয়ে গেলে সব চাকাই তখন গড়গড়িয়ে চলতে থাকে, বিশেষ একদিকে চলার প্রবণতা আর থাকে না। বাঁক নেবার সময় রিক্সার পেছনের যে চাকাটিকে চেইনের মাধ্যমে ঘোরানো হয় শুধু তারই নির্দিষ্ট বেগ থাকে, পেছনের অন্য চাকাটি চাহিদা অনুযায়ী বেগে ঘোরে। ফলে বাঁক নেওয়ার সময় পেছনের দুটো চাকার আলাদা আলদা বেগ অর্জন করে চলতে কোনো অসুবিধা হয় না।     

তবে শুরুতেই বলেছি রিক্সার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন –-- রিক্সার জায়গা নিয়েছে নতুন প্রযুক্তির ব্যাটারি চালিত ই-রিক্সা। যে প্রযুক্তি রিক্সাকে চলার পথে সহজ সমাধান যুগিয়েছে, আজ সেই প্রযুক্তিই তার সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করেছে। একমাত্র সময়ই বলতে পারবে আগামী দিনে এই সহজ যানটি বিলুপ্তির পথে বাঁক নেবে কি না। 



সূচিপত্রে যাওয়ার সূত্র  

Comments

  1. আচ্ছা, মানুষের শরীরটাকে যদি একটা গাড়ি ভাবি বা রিক্সা, তবে পা দুখানাকে নিশ্চয় চাকা বলা যেতেই পারে, তবে সেটা সাইকেলের না রিকশার নাকি গাড়ির, সে বলতে পারছি না। শত সহস্র নিউরন ফিউরনের বাস, গ্রে বা হোয়াইট বস্তুর আবাসভূমি করোটি নাম্নী বস্তুটি, যাতে লাল পেড়ে সাদা শাড়ির ঘোমটা দিয়ে শাকচুন্নিরা আদি অনন্তকাল থেকে আমাদের কারণে অকারণে ভয় দেখিয়ে চলেছে, সেই ঘাড়ের ওপর স্থির আমাদের একমাত্র জ্ঞানী অঙ্গটি যে ইঞ্জিন, সে বিষয়ে নিশ্চয় কারো সংশয় নেই। আচ্ছা, মেরুদন্ডই কি টর্ক ? নিশ্চয় তাই হবে! প্রশ্নটা হলো, ডিফারেনশিয়াল তবে শরীরের কোন অঙ্গটি? আছে নিশ্চয় কোথাও! না হলে চাকা কত দ্রুত চলবে, থুরি, পা কত দ্রুত নড়বে, মানে হাঁটি-হাঁটি পা-পা নাকি দৌড়, ডিফারেন্ট করবে কে আর রেগুলেটই বা করবে কে? পায়ের সঙ্গে একই তালে হাতদুখানি সামনে পেছনে দুলবে তাও আবার ডানের সাথেই বাঁ আর বাঁয়ের সাথে ডান একই তালে তাল রেখে, এতসব করছে টা কে ? নাহ্, এ জটিল ধাঁধার উত্তর আমার নিরেট মাথার কম্ম নয়। ও হ্যাঁ, পেশী নামক আরো একটি বস্তু যে রয়েছে, তিনি তো আর হাত গুটিয়ে বসে নেই, তার কার্যকলাপ ভুললে তো চলবে না ! তবে?
    সাইকেল হলো, রিক্সা হলো, গরুরগাড়ি হবে নিশ্চয়, ঠেলা গাড়িও চলছে আদি অনন্তকাল ধরে, প্যারামবুলেটর ঠেলে চলেছে আপামর মধ্যবিত্ত বাপ মা, সেও তো এক যান বটে। বাবু সুপ্রিয়, হরেক যানের চলন রহস্য ফাঁসের সাথে মানব চলনের রহস্যটাও ফাঁস করে দিও আগামী কোনদিন! 😀
    জয় হে।।

    ReplyDelete
  2. ঋদ্ধ হলাম ♥️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়। অষ্টম পর্ব।

টৌন জলপাইগুড়িঃ সুয়ো স্টেশন দুয়ো স্টেশন

গোসানী মঙ্গল অবলম্বনে 'তথাস্তু': রঙ্গন রায়। তৃতীয় পর্ব।